রাজু আহমেদ| প্রকাশ, ২০ এপ্রিল ২০২৫
রাজধানীর মিরপুর এলাকার পল্লবী থানাধীন মিল্লাত ক্যাম্প, রহমত ক্যাম্প, বেগুনটিলা বস্তি, কুর্মিটোলা বস্তি, নিউ কুর্মিটোলা বস্তি, রাজুর বস্তি এবং কালাপানি বস্তিজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে এক ভয়ঙ্কর অপরাধ সাম্রাজ্য। নেতৃত্বে নারীরা, হাতিয়ার মাদক, অস্ত্র, নারী পাচার ও কিশোর গ্যাং।
এই মাফিয়া সিন্ডিকেট এখন শুধু ভয় নয়—পরিণত হয়েছে এক সুগঠিত ব্যবসায়। তাদের প্রভাব, তাদের প্রতিপত্তি—পুলিশ, রাজনীতি ও তথাকথিত সাংবাদিকের ছত্রছায়ায় অদৃশ্য এক দুর্ভেদ্য বলয় তৈরি করেছে।
‘মাদক সম্রাজ্ঞী’ সাথী গ্রেফতার, আড়ালে রইল মূল সিন্ডিকেট
সম্প্রতি ডিএনসির বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার হয় ‘মাদক সম্রাজ্ঞী’ খ্যাত সাথী। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টাকার ইয়াবা। কিন্তু এই গ্রেপ্তার কেবল বরফচূড়ার একচিলতে অংশ। এর আড়ালে রয়েছে বহুস্তর বিশিষ্ট, গভীর-গোঁড়া সিন্ডিকেট যার নেতৃত্বে রয়েছে এক ভয়াল নাম—‘পৃথিবী’।
ক্যাম্পজুড়ে ‘পৃথিবী’র রাজত্ব
মিল্লাত ও রহমত ক্যাম্পে ‘পৃথিবী’র অধীনে পরিচালিত হয় অন্তত ১৫০ জন নারী-কেন্দ্রিক মাদক বাহিনী। তার সহযোগী নারীরা—আনোয়ারি, সাম্মী, ছায়মা, রুমা, সুমা (বোন), এবং তাদের সশস্ত্র সঙ্গী মুস্তাক, সুমন, শাহানা, নাটা জুম্মন। এদের প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং বাহিনী।
রাত নামলেই লাইনের মাথায় বসে খোলা মাদকের বস্তা, পাইকারি ও খুচরা বিক্রি, অস্ত্রের মহড়া। নিজস্ব আস্তানা, দখলদারিত্ব, এবং প্রভাব এতটাই প্রবল যে স্থানীয়রা মুখ খুলতে ভয় পায়।
মাদক মাফিয়া নারীদের অবস্থান মানচিত্র: বস্তির ভিতরে সিন্ডিকেট হেডকোয়ার্টার।
সাম্মী, শাকিলা, সায়মা: মিল্লাত ক্যাম্প, ২ নম্বর লাইনের প্রথম গলি।
আনোয়ারি, ছনি, দুলারি, লাখি বেগম: ইমামবারার পেছনে, ২২ নম্বর লাইন।
মুস্তাক ও ছেলে সুমন: ডুইপ প্লট, ৪ নম্বর লাইন।
নাটা জুম্মন ও স্ত্রী শাহানা, সাব্বো, কালাম: ২২ নম্বর লাইনের জোড়া বিল্ডিংয়ের সামনে।
ভাবীর বাংলা মদের স্পট: এডিস ক্যাম্প, ফকিরপট্টি, ভুসির দোকানের গলি।
পল্লবী ছাড়িয়ে পুরো রাজধানীতে বিস্তার
শুধু মিল্লাত ক্যাম্প নয়—বেগুনটিলা, কুর্মিটোলা, কালাপানির মতো বস্তিগুলোতেও নারী ডনদের একচ্ছত্র দাপট।
শাহজাদী: বেগুনটিলার নিয়ন্ত্রক। ভাই গরু আমজাদ সহযোগী।
শারমিন: কুর্মিটোলা ক্যাম্পের প্রভাবশালী নাম।
শাহানাজ (হিরোইন): কালশী মাদ্রাসার পেছনে অবস্থান নেয়া মাদক সম্রাজ্ঞী।
নাগিন সোহাগ ও মা বিথি: চাকরির নামে নারীদের পাচারে জড়িত।
শাহজাদীর অধীনে রয়েছে অন্তত ৫০ জন নিয়মিত মাদক বিক্রেতা—বস্তির অলিগলি চষে বেড়ায় তারা।
টেকনাফ থেকে ক্যাম্প: কোটি টাকার সাপ্লাই চেইন
টেকনাফ থেকে গভীর রাতে গাড়িতে ও নারীদের দেহে লুকিয়ে চলে আসে ইয়াবা ও হিরোইনের কোটি কোটি টাকার চালান। টঙ্গী, মোহাম্মদপুর, আবদুল্লাহপুর হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর বস্তি ও ক্যাম্পজুড়ে।
এই পাচারে যুক্ত ১০ জন ‘সুন্দরী পরিবহনকর্মী’র কাজ হলো নিরাপদে মাদকের ডেলিভারি নিশ্চিত করা।
প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা: কে রুখবে এই ‘নারী-সিন্ডিকেট’?
পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, “তদন্ত চলছে। তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কিন্তু প্রশ্ন জাগে—যখন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এসব ক্যাম্পে চলে প্রকাশ্য মাদক কারবার, তখন প্রশাসনের চোখ কোথায়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিন্ডিকেট কেবল আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়—এটা জাতীয় নিরাপত্তা বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনের দুর্বলতা না কাটলে এই ‘অপরাধের নারীমুখী রাজনীতি’ বন্ধ হবার নয়।
মিল্লাত ক্যাম্প, রহমত ক্যাম্প, এডিসি ক্যাম্প ও বস্তি তে—‘মাদকের দুর্গ’, যেখানে রাতে চলে নারী ডনদের মিলনমেলা, পাশে থাকে তাদের বাহিনীর সদস্যরা। শুধু মাত্র, সেনাবাহিনী ও ডিবির উপস্থিতি টের পেলে গা ঢাকা দেয়।